ঈদে মানে আনন্দ। এদিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে ঈদ উদযাপন করে শিশুরা। তবে, যারা এতিম, তারা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তবু, জীবন থেমে থাকে না। ঈদও আসে নিয়ম মেনে। পরিবারের সান্নিধ্য না পেলেও ঈদের আনন্দে কমতি ছিল না ফরিদপুরের সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা) থাকা শিশু-কিশোরীদের। ঈদ উপলক্ষে তাদের দেওয়া হয়েছে নতুন পোশাক। দুপুরে তাদের দেওয়া হয়েছে উন্নত খাবার। খাওয়া শেষে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ঈদের বকশিস। এছাড়াও তাদের জন্য ছিল নানা আয়োজন। মঙ্গলবার (৩ মে) ঈদুল ফিতরের দিন দুপুরে ফরিদপুর সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা) গিয়ে দেখা যায়, নতুন জামা-কাপড় পরে একে অপরের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছে বাবা-মাহারা শিশু-কিশোরীরা।
শিশু-কিশোরীরা যেন অন্যদের মতোই ঈদ উদযাপন করতে পারে, সেজন্য সরকারি শিশু পরিবারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ফরিদপুর সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) শহরের টেপাখোলায় অবস্থিত। এখানে ১৭৫ জন শিশু-কিশোরী আছে। অনেকের বাবা নেই, কারো মা নেই, আবার কারো কারো বাবা-মা উভয়ই নেই। এসব শিশু-কিশোরীর থাকা-খাওয়া, পড়ালেখাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা এখান থেকেই করা হয়। প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত অধ্যয়ন করছে এখানকার মেয়েরা। সরকারি শিশু পরিবারে থাকা এসএসসি পরীক্ষার্থী মানসুরা জানায়, শিশুকাল থেকে এখানেই আছে সে। তার বাবা-মা নেই। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে সে। ঈদ কেমন কাটল, প্রশ্নের জবাবে মানসুরা বলে, ‘খুব ভালো কেটেছে ঈদের দিন।
ঈদের আগের দিন নতুন পোশাক দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন সকালে সেমাই, রুটি, খিচুড়ি খেতে দেওয়া হয়েছে। দুপুরে পোলাও, মাংস, দই, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হয়েছে। সবার সাথে মিলেমিশে ঈদ পালন করলাম।’ মানসুরা আরও বলে, ‘পরিবারে কেউ নেই, এ কথা ভুলে গেছি। এখানে যিনি দায়িত্বে আছেন, তাকে আমরা মা বলে ডাকি। আমাদের সকলকে খুব যত্ন করেন তিনি। আমাদের খুব খেয়াল রাখেন।’ দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া বলে, ‘এখানে সবাই মিলেমিশে থাকি। থাকা-খাওয়া, পড়ালেখা, খেলাধুলা সবই করতে পারি। ঈদের দিন খুব আনন্দে কাটল। অনেক মজা করেছি। হাতে মেহেদি লাগিয়েছি, সেজেছি, নতুন পোশাক পড়ে সবার সাথে গল্প করেছি। দুপুরের খাবার খেয়েছি। খাওয়ার পর মা (তত্বাবধায়ক) আমাদের সবাইকে বকশিস দিয়েছেন।’ প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা বলে, ‘আমি ছোট বলে অন্যরা আমাকে খুব আদর করে। বাড়ির কথা মনে নেই। এটাই আমার বাড়ি। আমি আমার বাড়িতেই ঈদ করেছি। মা-বোনদের সাথে ঈদের দিন খুব মজা করেছি।’
ফরিদপুর সরকারি শিশু পরিবারের (বালিকা) তত্ত্বাবধায়ক তাসফিয়া তাছরীন বলেন, ‘এখানে ১৭৫ জন শিশু ও কিশোরী আছে। প্রথম শ্রেণি থেকে ডিগ্রিতে পড়ালেখা করছে, এমন মেয়েরাও আছে। যারা খুব ছোট বয়সে এখানে এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এখন ডিগ্রিতে পড়ছে, কেউ ম্যাটসে পড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওদের বাবা-মা নেই। ওরা আমাকে আম্মা বলে ডাকে। পেশাগত দায়িত্ব পালনই নয়, মা হিসেবে ওদের আবদারগুলো পূরণ করার চেষ্টা করি। ঈদে অন্য শিশুরা যেমন আনন্দ-ফূর্তিতে কাটায়, ঠিক সেভাবেই যাতে ওরা আনন্দে দিনটি কাটাতে পারে, সেজন্য নানা ধরনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। নতুন কাপড়, উন্নত খাবার, এমনকি নতুন টাকা বকশিস হিসেবে দিয়েছি। নিজের সন্তানের মতো করে ওদের দেখাশুনা করি।’ তাসফিয়া তাছরীন জানান, এখানে থাকার জন্য উন্নত বেড আছে। নিয়মিত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পরিবেশন করা হয়। পড়ালেখার জন্য আছে লাইব্রেরি। খেলাধুলার জন্য আছে বিশেষ ব্যবস্থা। এখানকার সবাই পড়ালেখা করে। পার্শ্ববর্তী নুরুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে তারা।
এখানকার কর্মচারীদের দিয়ে তাদের স্কুলে পাঠানো হয়, স্কুল শেষে তাদের আবার নিয়ে আসা হয়। অনেকে লজ্জায় কিছু বলতে না পারলে, তার জন্য আছে ‘ইচ্ছাপূরণ’ বক্স। ইচ্ছার কথা কাগজে লিখে ওই বক্সে রাখলে আমরা তার ইচ্ছা পূরণ করা হয়। ফরিদপুর সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুল হুদা বলেন, ‘শিশু-কিশোরীরা আমাকে বাবা বলে ডাকে। তাই, নিজের সন্তানের মত করে ওদের লালন-পালন করছি। অনেক সময় সরকারি বরাদ্দ না থাকলেও নিজের অর্থ দিয়ে ওদের আবদার মেটাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যারা আছে সবাই খুব ভালো। ঈদ ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে ওদের একটু আনন্দ দিতে অন্য আয়োজন করে থাকি। এখান থেকে পড়ালেখা শেষে করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের দেখলে খুব ভালো লাগে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।